‘নারী হয়ে ক্রিকেটে আসার গল্পটা একটু বেদনাদায়ক ছিল, আমি বিশ্বাস করি যারা এই বেদনা টুকু মেনে নিতে পারেন তারাই সফল হন, মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলি পরিবার থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশির অনেকের কাছেই অনেক সময় বিভিন্ন কথা শুনতে হয়েছে, এবং এখনো শুনতে হয়। ‘আমার মতো করে কোন মেয়ে যেন ক্রিকেটে আসতে বাধাবিপত্তির শিকার না হয়; এজন্য আমার একাডেমীর যাত্রা শুরু করি; আলাপচারিতায় এমনটিই জানাচ্ছিলেন, দেশে নারীদের একমাত্র ক্রিকেট একাডেমী ‘ওমেন ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও ক্রিকেটার আরিফা জাহান বীথি’। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : মোশারফ হোসাইন
রংপুরের শৈশব কাটানো এই নারী নিজের শহরেই চালাচ্ছেন দেশের একমাত্র নারী ক্রিকেট একাডেমী। তার একক প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা এই ‘ওমেন ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ২৫০জন নারী। ক্রিকেটে যেন ছেলেদের সাথে অনুশীলনের ইস্যু পরিবার ও সমাজ থেকে না আসে এবং অর্থ সংকটে যেন কোন মেয়ে ক্রিকেট থেকে বঞ্চিত নাহয় সেজন্য নিজেই নারীদের ক্রিকেটার হিসেবে তৈরি করতে বিনামূল্যে অনুশীলন করিয়ে যাচ্ছেন বীথি। আরিফা জাহান বীথি বলেন, অনেক মেয়েই ক্রিকেটে আসেনা ছেলেদের সাথে অনুশীলন করতে হয় সেজন্য, অথচ তাদের মনে লালিত স্বপ্ন ক্রিকেটার হবে, অনেকেই পড়েন অর্থ সংকটে, অর্থের অভাবে ক্রিকেট অনুশীলন করতে পারেনা, তাদের বিনামূল্যে অনুশীলন করানোর উদ্দেশ্য নিয়েই একাডেমির যাত্রা শুরু করি।
সালেমা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্রিকেটের সাথে জড়িয়ে পরেন আরিফা জাহান বীথি, এরপর ভালোবাসা আর ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায় ক্রিকেটের প্রতি, স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ক্রিকেটে ভালো পারফারম্যান্স করায় জেলা পর্যায়ে খেলার সুযোগ পান, এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি চেষ্টা সাহস আত্মবিশ্বাস ও ইচ্ছেশক্তি দিয়ে বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যান ক্রিকেটে। ২০১০ সালে পেশাদার লিগ খেলা শুরু করেন বীথি। ঢাকা প্রিমিয়ারলিগ, ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট একাডেমিতে ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছেন বীথি। কিন্তু ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশনের এক ম্যাচ চলাকালীন সময়ে নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে বীথির। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে বলেন নাকে ইনফেকশন হয়েছে, খেলা চালিয়ে গেলে বড় ক্ষতি হতে পারে, ফলে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হয় তার।
আলাপচারিতায় বীথি জানান, ক্রিকেট আসার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান স্কুলের, স্কুলের শিক্ষক ও বাবা মায়েরা সমর্থন না দিলে হয়ত এতোদূর আসা হতো না, ইচ্ছে ছিল আইনজীবী হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানোর শেষমেশ ক্রিকেট দিয়েই মানুষের পাশে তিনি। ক্রিকেটের বাইরেও সমাজের নিবেদিত প্রাণ হয়ে অসহায় মানুষের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন বীথি। তিনি বলেন, করোনার শুরুর দিকে রাস্তায় অসহায় মানুষদের রান্না করে খিচুড়ি দিয়েছি, কর্মহীন দিনমজুরদের মাঝে ৭ দিনের খাবার দিয়েছি। গর্ভবতী মায়েদের কাছে নিজে গিয়ে খাবার পৌঁছে দিয়েছি, মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া, ১১০ বছর বয়সের বৃদ্ধি মায়ের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া, রংপুরের বন্যা পরিস্থিতে মানুষদের ঘরে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়া, কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য ১৯ জন শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া, কোরবানির ঈদে অসহায়দের ঘরে মাংস পৌঁছে দেওয়া, প্রতি ঈদে সিকিউরিটি গার্ডদের ঈদের রান্না করে খাবার দেওয়া। ৫জন বৃদ্ধ মায়ের ঘর করে দেওয়া, বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য সেলাই মেশিন দেওয়া। পুজাতে শিশুদের নতুন জামা কাপড় উপহার দেওয়া, একজন মায়ের ৩টি জমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করে করোনার সময়; তখন তাদের সাহায্য করার মত কেউ ছিল না, তখন সেই পরিবারকে প্রতিদিন খাবার দিয়েছি, শিশুদের দুধ, কাপড় দিয়েছি। একটি ভিক্ষুকের ঘর করে দিয়েছি, তার মেয়েকে পোশাক দিয়েছি। দরিদ্র মানুষদের টিউবওয়েল, তোশক কম্বল দিয়েছি। শীতে পরিষ্কার কর্মী, অসহায় ও প্রতিবন্ধী মানুষদের কম্বল দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে মানুষকে সাহায্য করে যাচ্ছেন বীথি নিয়মিতই।
জাতীয় ক্রিকেট লিগে কোচ হিসেবে গিয়ে রংপুরে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি আনাটাই ছিল এখন পর্যন্ত বড় অর্জন বলে জানান বীথি। তিনি আরও জানান, একাডেমী যেহেতু নতুন এবার দু’বছরে পা রাখলো, আমার স্বপ্ন আগামী পাচ বছরে অন্তত ৫জন আমার একাডেমী থেকে জাতীয় দলে খেলবে এই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ করে যেতে চাই সবসময়। মেয়েরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে, এখন সবক্ষেত্রে এগিয়ে মেয়েরা এর বাস্তব উদাহরণ আজকের বাংলাদেশ। মেয়েরা যেহেতু সবই করতে পারে তাহলে ক্রিকেটে আসতে পারবেনা কেন?। ক্রিকেট শুধু খেলা নয়! ক্রিকেট যেমন দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, তেমন নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতও গড়ে দেয়, তবে কেন ক্রিকেটে আসা মেয়েদের বাধা!। এই বাধার দেয়াল ভেঙে মেয়েদের ক্রিকেটে এগিয়ে আসার আহ্বান ও পরিবারকে মেয়েদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার পরামর্শ তার। বীথির মনের অব্যক্ত কথা কী এখন? জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি যতোটা চেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশী পেয়েছি আমি কখনো ভাবিনি এতো মেয়ে আমার একাডেমিতে ভর্তি হয়ে অনুশীলন করবে, বিকেএসপি প্রমিলা প্রশিক্ষণার্থী বাছাই কার্যক্রম ২০২০-২১ এর চূড়ান্ত ফলাফলে আমার ‘ওমেন ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমী’ থেকে ১১ জন পরীক্ষা দিয়েছিলা এরমধ্যে ৭ জন সুযোগ পেয়েছে। মেয়েদের আলাদা নিরাপত্তার মাধ্যমে অনুশীলন করার জন্যে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মাঠ, একটি মাঠ হলে মেয়েরা আরও আগ্রহী হয়ে অনুশীলন করতে পারবে, তাদের অনুশীলন করাতে সহজ হবে এবং সহজে সফলতার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবো।