মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়…

হায়দার আলীর উঠান ভরা মানুষ। যে যার যার মতো হই-হুল্লোড় করছে। সমবেত সমাবেশে সর্বকনিষ্ঠ দর্শক হয়ে উৎসবের অংশ হয়ে যাই। মাঝে মধ্যে সমবেত কন্ঠে আওয়াজ হাত পাখা, হাত পাখা। পাড়ার একমাত্র শিক্ষিত মানুষ আব্দুল হালিম সরকার। রামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে তার মার্কা হাত পাখা।
পাড়ার মুরুব্বীদের উৎসব ভেদ করে হঠাৎ এক ঝড়। বিস্কিট ঝড়। সবাই হুড়-মুড়িয়ে পড়লো। সাথে আমিও। সুপার বিস্কিট। খাজ কাটা গোলাকার।
সবার ছোট হওয়ায় খুব সহজে কোচা ভরে বিস্কিট কুড়িয়েছি সেবার। তারপর শুরু মিছিল। মিছিলেও থেমে থেমে বিস্কিট ঝড়। সবার পেছনে স্লোাগানে আত্মহারাদের সঙ্গী হয়ে আনন্দের ভাগ নিতে ভুল করিনি একটুও। সেবার মুরুব্বীদের কথায় সবাই জোট বেঁধে হালিম সরকারকে নির্বাচিত করে বিজয়ের আনন্দ অন্যমাত্রা যোগ করে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা মানুষগুলোর মুখে।
বলছিলাম দুই যুগ আগের এক নির্বাচনের কথা। এরপর পদ্মা-মেঘনায় কত জল গড়িয়েছে। মাটির ঘর, ভাঙ্গা বেড়া, বদলেছে। চালের ছন ভেদ করে বৃষ্টির জলে আর কারো বিছানা ভেজে না। সন্ধ্যা হলেই পাড়ায় বিদ্যুতের আলো জ্বলে। বাড়ি বাড়ি এলইডি টিভি, ফ্রিজ, ফ্যান। দুই যুগ আগের হুক্কা, ছেড়া কাঁথা সবই বিদায় নিয়েছে। মাহমুদার মায়ের পরবর্তী প্রজন্ম আর খাড় দিয়ে মাথা ধোয় না। সেই খাড়ের জায়গা এখন সাবান-শ্যাম্পুর দখলে। ঘরে ঘরে মোবাইল-ইন্টারনেট। সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে- ঘরে ঘরে স্বচ্ছলতার বাতাস বইছে- কিন্তু মানুষগুলোর পরিবর্তন হয়নি। তাদের মনের কোন পরিবর্তন হয়নি, মনের দিক থেকে এখনো দুই যুগ আগের চিত্র দেখলাম এবার ইউপি নির্বাচনে।
প্রার্থীদের অনেকে বিদ্যালয় ছোঁয়নি, অধিকাংশই মাধ্যমিকের বারান্দায় ওঠেনি। ভোটাররাও কেউ আর পাড়ার মুরুব্বীদের মানে না। বাপ এক প্রার্থী তো তার বেটা আবার অন্য প্রার্থীর সমর্থক। কোন কোন পরিবার আলাদা আলাদা প্রার্থী ভাগ করে নিয়ে যার যার মতো ক্যানভাস (প্রচারণা) করছে।
লালমিয়া ভাই মরে যাওয়ার পর তার মেয়েরা বেশীদিন চায়ের দোকানটা চালাতে পারেনি। পাড়ায় তিন তিনটা চায়ের দোকান। সারাদিন যেখানে দশটা মানুষও বসে না। ভোটের মৌসুমে তিনটা দোকানই শিশু, নারী পুরুষে গমগম। ভোরের আলো ফোটা থেকে সুর্যাস্তের পর মধ্যরাত পর্যন্ত বেলাল, মধু আর জহুরুলের দোকানে ভীড়। মোটরসাইকেলের শব্দ পেলে নারীরাও বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। যখন যে প্রার্থী আসছে তার গুণগানের প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত সবাই। চা, পান, বিড়ি সিগারেট তো আছেই, সুযোগ বুঝে হাতের মুঠোয় ছোট বড় নোট গুজে দেয় প্রার্থীরা।
সেই নোট আবার সবার হাতে যায়না। ভোটের ব্যাপারীকে খুঁজে নেয় প্রার্থীর চোখ। ২০ ভোট, ৫০ ভোটের ঠিকাদারী বাবদ নগদ অর্থ চলে যায় ব্যাপারীর হাতে। পরেরদিন জানাজানির পর বাঁধে বিপত্তি। ভোটাররা ভাগ না পেয়ে অন্য প্রার্থীর স্লোগান ধরে। ভোটের ব্যাপারী দুরে দাড়িয়ে মিটমিটিয়ে হাসে। ভোটের আগের দিন পর্যন্ত এমন দৃশ্য ছিলো সদরের ১৩ ইউনিয়নের প্রায় সব পাড়া-মহল্লায়। এমনকি ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে ভোট কেনার প্রতিযোগীতায় নেমে যায় প্রার্থীরা। আগের রাতটা ছিলো অন্যরকম। পাড়ায় পাড়ায় মহড়া বসায় প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা। ছিলো পেশী শক্তির মহড়াও।
ভোটের দিন ছিলো টান টান উত্তেজনা। ফলাফল নিয়ে পরাজিতদের মনে ক্ষোভের সঞ্চয়। বিজয়ীদের মনে আনন্দ নেই। খরচের টালি খাতায় ছানাবড়া চোখ।
বোকা মনে প্রশ্ন জাগে মাঝখানে মাত্র দুই যুগ। সময় বদলেছে। প্রযুক্তির ছোয়ায় বদলেছে মানুষের জীবনমানও। কিন্তু মনন বদলেছে কতখানি? প্রশ্ন থেকে যায়।
আর কেনইবা চেয়ারম্যান মেম্বার হতে এতো প্রতিযোগীতা। যেখানে একজন ইউপি মেম্বারের মাসিক সম্মানী পাঁচ আর চেয়ারম্যানের দশ হাজার। উদ্দেশ্য সেই সামান্য সম্মানী না’কি অন্যকিছু।
এই যে নির্বাচনে লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ তা উঠবে কার ঘরে। স্থানীয় সরকারে কত টাকা লুটপাট হয়, সেই জায়গায় খুব কমই হাত পড়ে, যার ফলে লুটপাটের দৌড়ে অংশ নিতে যে জনসেবার নামে বিনিয়োগের পরিমানটাও দিন দিন বাড়ছে, সেই প্রশ্নটা কি অমুলক!
মুনীর চৌধুরীর নাটক রক্তাক্ত প্রান্তরের সেই ডায়লগ হয়তো বাস্তবতা হয়ে ধরা দেয়, ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারনে বদলায়…!’
-হেদায়েতুল ইসলাম বাবু, সাংবাদিক
সুত্র: আমারজেলা ডট নিউজ