গাইবান্ধাসুন্দরগঞ্জ

হোসিয়ারি শিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া, বেকার তিন সহস্র্রাধিক কারিগর

আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে কাজ হারিয়ে পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন শীতবস্ত্র উৎপাদনকারী এলাকা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহরের হোসিয়ারি শ্রমিক ও কারিগররা। আসন্ন শীত মৌসুমকে সামনে রেখে এখানকার প্রধান শীতবস্ত্র বিপণনকেন্দ্র নয়ারহাটে গত দু’মাস যাবত প্রতিদিন ভোর থেকে গভীররাত পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে লাখ লাখ টাকার শীতবস্ত্র। অন্যদিকে, প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা একই এলাকার এ শিল্প সংশ্লিষ্ট তিন সহস্র্রাধিক কারিগর বেকার হয়ে পড়েছেন। দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন যোগাতে তারা এখন হিমশিম খাচ্ছেন।

জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই এ এলাকার নারী-পুরুষ-শিশুসহ প্রায় সকল বয়সী মানুষ কারিগর হিসেবে সুয়েটার তৈরির ফ্লাট মেশিনে বিভিন্ন ধরনের সোয়েটার, মাফলার বা মোজা তৈরি করতেন। বর্তমানে এখানকার অধিকাংশ কারখানাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন কম্পিউটারাইজড মেশিন স্থাপন করায় স্বল্পসময়ে ও কম শ্রমিকে উন্নতমানের বিপুলসংখ্যক শীতবস্ত্র উৎপাদিত হচ্ছে। এর ফলে কাজ হারানো ওই কারিগর ও শ্রমিকদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা বাড়িতে বসে হাতপাখা ও টুপি তৈরি করে কোনমতে দিনযাপন করছেন। পুরুষ শ্রমিকদের অনেকেই রিক্সা-ভ্যান ও অটোভ্যান চালানো থেকে শুরু করে রেলগাড়ি এবং বিভিন্ন হাটবাজারে ফেরি করে পাখা, টুপি, মোজাসহ বিভিন্ন মালামাল বিক্রির পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন বাধ্য হয়ে। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রিও হয়েছেন অনেকে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত শতকের দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ে যে পাড়ায় প্রথম দুটি হাতে চালানো মোজা তৈরির মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে এখানে হোসিয়ারি শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছিল। কারিগরপাড়া নামে পরিচিত সেই পেপুলিয়া-বনগ্রাম। এখন হোসিয়ারি মেশিনশূন্য হয়ে পড়েছে। এখানকার কারিগররা নিজেদের ছোট ছোট মেশিন ছাড়াও চারপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে স্থাপিত ছোট-বড় কারখানাগুলোতে কারিগর বা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন বছরের অধিকাংশ সময়। মেশিন চালানো থেকে শুরু করে সুয়েটার, মাফলার বা মোজা সেলাই, ইস্ত্রি, প্যাকিংসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত থাকতেন তারা। এখানকার তৈরি শীতবস্ত্র দেশের এক তৃতীয়াংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে। গত পাঁচ-ছয় বছরে বিদেশ থেকে আমদানি করা স্বয়ংক্রিয় ও কম্পিউটারাইজড অত্যাধুনিক মেশিন স্থাপন করেন অনেকগুলো বড় বড় কারখানা স্থাপন হয়ে যায় এ এলাকায়। আগে প্রতিটি মেশিনে একজন করে কারিগর কাজ করতেন। বর্তমানের আধুনিক এসব মেশিন শীতবস্ত্র উৎপাদনে এক শ’ গুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন। বর্তমানের আধুনিক এসব মেশিন চলে সম্পূর্ণরূপে কম্পিউটারের ডিজাইন ও নিয়ন্ত্রণে। একজন অপারেটর একাই এমন পাঁচ-সাতটি মেশিন চালনা করতে পারেন। আগের একশ’ জন কারিগর ও শ্রমিকের এমন কারখানা চলে মাত্র পাঁচ থেকে সাতজন অপারেটরের মাধ্যমে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাজ হারিয়েছেন কারিগর পাড়ার অধিকাংশ কারিগর।

বনগ্রাম কারিগর পাড়ার গৃহবধূ তহমিনা জানালেন, প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত এ পাড়ার পুরুষদের পাশাপশি নারী ও শিশুরাও বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন। এর আয়ে তারা বেশ স্বচ্ছল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু কয়েকবছর থেকে হোসিয়ারি শিল্পে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক মেশিন হওয়ায় ছোট-ছোট কারখানাগুলো বন্ধের পাশাপশি কারিগর ও সাধারণ শ্রমিকরা কাজ হারাতে শুরু করেন। এ বছর বেকারত্বের হার ঠেকেছে একেবারে চরম পর্যায়ে। অনেক বাড়ির পুরুষরাই পেশা বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে নারী ও শিশুরা হোসিয়ারি মেশিনের কাজে ব্যবহৃত সুতা কিনে এনে বাড়িতে বসে হাতপাখা ও টুপি বানাচ্ছেন বলে জানালেন একই পাড়ার প্রতিবন্ধী গৃহবধূ শান্তনা বেগম।

কোচাশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন মন্ডল বলেছেন, হোসিয়ারি শিল্পে বিপ্লব নিয়ে আসা এখানকার আসল কারিগররাই এখন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছেন। বড় বড় ও আধুনিক কারখানার ভিড়ে হারাতে বসা কোচাশহরের শীতবস্ত্র তৈরির কারিগরদের রক্ষা করতে সরকারি সাহায্য বা স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে ছোট ছোট কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসন করা এখন সময়ের দাবি।

সুত্র: সংবাদ

Back to top button