সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদে গাইবান্ধায় বিক্ষোভ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান ও কঠোর নজরদারির মধ্যেই ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজামন্ডপ, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে গাইবান্ধা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) জেলা শহরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দানসহ বিভিন্ন দাবি জানান। গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (গানাসাস) সামনে শহরের ডিবি রোডে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ২টা পর্যন্ত কর্মসূচি চলাকালে এসব দাবি জানান তারা।
বিক্ষোভকারীদের উত্থাপিত দাবিগুলোর মধ্যে আছে- সংখ্যালঘুদের সামাজিক-পারিবারিক, রাজনৈতিক ও আইনগত নিরাপত্তা নিশ্চিত, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মদদদাতাদের শনাক্ত ও বিচার, সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার মন্দিরগুলো সংস্কার, রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকান্ড, লুটপাটের ক্ষতিপূরণ, হামলায় জড়িতদেও গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত, জাতীয় সংসদে আইন করে মন্দির ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান প্রভৃতি।
এর আগে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে সকালে গানাসাস চত্বরে জড়ো হন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সমাবেশ শেষে একটি মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এদিকে কর্মসূচির শুরু থেকেই ‘জাগো মানুষ, রুখো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস’, ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে জেগে ওঠো বাংলাদেশ’, ‘ যদি তুমি মানুষ হও, ধর্মান্ধতা রুখে দাও’, ‘ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ সবার’, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরে আসো বাংলাদেশ’, ‘আমরা ধর্মান্ধ না, আমরা বাঙালি’ ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, জঙ্গিবাদের ঠাঁই নাই’ প্রভৃতি স্লোগান সম্বলিত ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড বহন করেন বিক্ষোভকারীরা। এসময় কর্মসূচিতে অংশ নেয়া অনেকের হাতেই জাতীয় পতাকা দেখা যায়।
উদীচী গাইবান্ধার সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুমের সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হওয়ার পর সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাজহার উল মান্নান, সিপিবি জেলা সভাপতি মিহির ঘোষ, জাসদ জেলা সভাপতি গোলাম মারুফ মনা, গণফোরাম জেলা সভাপতি ময়নুল ইসলাম রাজা, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের জেলা সভাপতি রণজিৎ বকসি সূর্য্য, গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের সদস্য সচিব ও জেলা বার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. সিরাজুল বাবু, জনউদ্যোগ গাইবান্ধার সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্তী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট জেলা সভাপতি আলমগীর কবীর বাদল, সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জেলা সাধারণ সম্পাদক রিক্তু প্রসাদ, সমাজকর্মী জাহাঙ্গীর কবির তনু, উন্নয়নকর্মী জয়া প্রসাদ, মানবাধিকার কর্মী কাজী আব্দুল খালেক, মাজেদা খাতুন, হিন্দু যুব পরিষদ নেতা স্বপন কুমার রায়, রবিদাস ফোরাম জেলা সাধারণ সম্পাদক খিলন রবিদাস, বিডিইআরএম এর জেলা আহবায়ক সন্তোষ বাসফোর, প্রমুখ।
বক্তারা তাঁদের বক্তব্যে বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য যারা দায়ী সেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এমন হামলার ঘটনা দেখতে হচ্ছে। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও দেশে বড় ধরণের সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলগুলো হামলার পর প্রতিকারের আশ্বাস দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলেও অভিযোগ করেন তারা। দোষী ব্যক্তিদেরকে দ্রুত বিচার আইনের আওয়তায় এনে বিচারের দাবী জানান।
আজ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির-মন্ডপসহ হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধ তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনার ওপর আঘাত করেছে একটি চক্র। এ চক্রটি দেশকে ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এ দেশ যে ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তাতে ধর্মের বিভেদ নেই। সংখ্যালঘুদের উপর এ ধরনের হামলা মেনে নেওয়া যায় না। কারা দাঙ্গা বাধিয়ে মানুষ মারার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে তাদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজামন্ডপ, বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার প্রতিবাদে এই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ যৌথভাবে আয়োজন করে গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চ, জনউদ্যোগ, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, গণ উন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে), ‘আমরাই পারি’ জেলা পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট, জেলা সামাজিক উদ্যোক্তা দল, মানবাধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক, দূর্বার নারী নেটওয়ার্ক, নারী ঐক্য পরিষদ, বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ হিন্দু যুব পরিষদ, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম), হরিজন ঐক্য পরিষদ, পৌর হরিজন-বাসফোর সমাজ, মাইনরটি রাইটস্ ফোরাম, রবিদাস ফোরাম ও জিবিভি নেটওয়ার্ক, গাইবান্ধা।
সুত্র: গাইবান্ধা ডট নিউজ