লক্ষ্য পূরণে ছেলেকে নিয়ে ১০০০ কিলোমিটার হাঁটলেন ক্যাপ্টেন বাবা

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাদেক আলী সরদার। কনকনে শীত উপেক্ষা করে একটি মহৎ উদ্দেশ্য সফলের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে সাথে নিয়ে হাঁটছেন গাইবান্ধা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকা। পায়ে হেঁটে ভ্রমণে বেরিয়ে এই দুই বাবা-ছেলে দেখছেন এসব জেলার প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন, সফল উদ্যোক্তা, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অসুস্থ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ নতুন নতুন এলাকা। ইতোমধ্যে তারা ১০০০ কিলোমিটরের বেশি পথ অতিক্রম করেছেন। দাদা ও বাবার মুখে হেঁটে হেঁটে ভ্রমণের গল্প শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে সঙ্গী হয়েছেন সাদেক আলীর ছোট্ট দুই নাতি-নাতনিও। ছেলে মোস্তাফিজুরকে সাথে নিয়ে সাদেক আলী সরদার ছুঁবেন কয়েক সহ¯্র কিলোমিটারের ঘর। তবে আগামী মাসে পায়ে হেঁটে সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) মাজার দেখতে যাবেন বলে জানান তারা।
সাদেক আলী সরদারের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধা পৌরসভার মধ্য গোবিন্দপুর এলাকার বাসিন্দা সাদেক আলী সরদার (৬৬)। ছিলেন সেনাবাহিনীর অনারারী ক্যাপ্টেন (প্যারা কমান্ডো)। ২০০৬ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করেন। আর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান (৩৫) ঢাকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে গাইবান্ধায় ব্যবসা করছেন। মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়ে মোছা. মারজানা রহমান দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে ও ছেলে মো. মাহাদী রহমানের বয়স প্রায় তিন বছর।
সাদেক আলী সরদার ও মোস্তাফিজুর রহমান জানায়, যাত্রা শুরুর আগের দিন বসে গন্তব্যের স্থান ঠিক করেন দুজন। পরদিন খুব ভোরেই বাড়ী থেকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েন তারা। গন্তব্যে পৌঁছার পর আবার বাড়ী পৌঁছান হেঁটেই। তবে বেশি দূরে গেলে তারা ফেরেন যানবাহনে।
বাবা-ছেলের দেওয়া তথ্যমতে, মহৎ উদ্দেশ্য সফলের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা শুরু করেন সাদেক আলী সরদার ও মোস্তাফিজুর রহমান। এদিন তারা যান গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানা দেখতে। ২২ ডিসেম্বর ফুলছড়ি উপজেলার আনন্দবাজার, ২৫ ডিসেম্বর সদর উপজেলার ত্রিমোহিনী, ২৬ ডিসেম্বর গাইবান্ধা সদর উপজেলার তুলসীঘাট, ২৭ ডিসেম্বর ফুলছড়ির ঐতিহ্যবাহী এলাকা বালাসীঘাট, ২৮ ডিসেম্বর ফুলছড়ির কালির বাজার, ২৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলা শহরে যেতে সময় লাগে ১৪ ঘন্টা ৫০ মিনিট ও ৩১ ডিসেম্বর সদর উপজেলার বাদিয়াখালীতে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি যান ফুলছড়ির বুড়াইল, ২ জানুয়ারি ঐতিহ্যবাহী পুরাতন ফুলছড়ি ঘাট, ৩ জানুয়ারি ফুলছড়ির বোঁচার বাজার, ৪ জানুয়ারি আবারও কালিরবাজার, ৫ জানুয়ারি আবারও আনন্দবাজার, ৬ জানুয়ারি পলাশবাড়ী উপজেলা শহর, ৯ জানুয়ারি আবারও ত্রিমোহিনী, ১০ জানুয়ারি আবারও কালির বাজার, ১১ জানুয়ারি সাদুল্লাপুর উপজেলা শহর, ১২ জানুয়ারি সাঘাটার বোনারপাড়া, ১৩ জানুয়ারি সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহর, ১৫ জানুয়ারি সাঘাটা বাজার, ১৬ জানুয়ারি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নাকাইহাট বাজারে, ১৮ জানুয়ারি বগুড়া জেলা শহরে যেতে সময় লাগে ১৫ ঘন্টা ১০ মিনিট ও ২৩ জানুয়ারি গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের তালুক বুড়াইল গ্রামে খাঁজা হাজির খামার পরিদর্শন করেন।
কিন্তু ২৪ জানুয়ারি সকালে ঘটে বিপত্তি। সাদেক আলী সরদার ও মোস্তাফিজুর রহমান প্রস্তুতি নিচ্ছেন হাঁটতে বের হওয়ার। আর তা দেখে বায়না ধরে সাদেক আলীর নাতনি মারজানা রহমান ও নাতি মাহাদী। ওরা দুজনও হাঁটতে বের হবে তাদের সাথে। তাই এদিনের ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে ত্রিমোহিনী পর্যন্ত চলে যান এই চারজন। মারজানা যাতায়াতের পুরো পথ পাড়ি দেয় পায়ে হেঁটেই। আর মাহাদী থাকে কখনো দাদার ঘাড়ে আবার কখনোবা বাবার ঘাড়ে বসে। এই দুই বাবা-ছেলে ২৯ জানুয়ারি সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কামারজানী বাজার ও ৩১ জানুয়ারি আবারও যান কালিরবাজারে।
১ ফেব্রæয়ারি যান সুন্দরগঞ্জের সোনারায় ইউনিয়নে বামনডাঙ্গা জমিদার বাড়ী, ২ ফেব্রæয়ারি আবারও তালুক বুড়াইল গ্রামে খাঁজা হাজীর খামারে, ৩ ফেব্রæয়ারি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নে নির্মাণাধীন বহুল আলোচিত তিস্তা সেতু দেখে বেলকা হয়ে ধুপনী, ৬ ফেব্রæয়ারি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার মুঘল বা সুলতানী আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন সুরা মসজিদ, ৭ ফেব্রæয়ারি বাবা সাদেক আলী সরদার ও ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান যান রংপুরের পীরগঞ্জ এলাকার মাদারগঞ্জ এলাকায়। পথে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার কয়েকশো বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী জামালপুর শাহী মসজিদ দেখতে যান তারা। ৯ ফেব্রæয়ারি রংপুরের পীরগাছা উপজেলায়, ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার হিলি স্থলবন্দর, ১৫ ফেব্রæয়ারি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ঐতিহাসিক রাজাবিরাট এলাকায় রাজ পরিবারের প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন দেখতে, ২১ ফেব্রæয়ারি সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের সোনাইডাঙ্গা গ্রামে ভাষা সৈনিক গোলাম মোস্তফার বাড়ী ও ২২ ফেব্রæয়ারি লালমনিরহাট জেলা পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে ১০০০ কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করেন দুই বাবা-ছেলে। এর আগে আরও বিভিন্ন সময়ে বেশ লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছেন এই দুজন।
১০০০ কিলোমিটারের বেশি এই দীর্ঘ পথ হেঁটে বেড়াতে গিয়ে তারা দেখেছেন, কয়েকশো বছরের পুরনো মসজিদ, ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়সহ বিভিন্ন প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া জমিদার বাড়ীর স্থান, সফল উদ্যোক্তার খামার, বহুল আলোচিত নির্মাণাধীন তিস্তা সেতুসহ অদেখা নতুন নতুন এলাকা। শুধু তাই নয়, খোঁজ নিয়ে গিয়েছেন ফুলছড়ির বোচারবাজার এলাকায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত নায়েক অসুস্থ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল হকের কাছেও।
জানতে চাইলে সাদেক আলী সরদারের নাতনি মারজানা রহমান জানায়, দাদা ও বাবার মুখে হেঁটে বেড়ানোর বিভিন্ন রোমাঞ্চকর গল্প শুনে আমারও তাদের সাথে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। তাই একদিন সকালে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেখে আমি বায়না ধরি। আমার দেখে ছোট ভাইটিও কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। পরে দাদা ও বাবা আমাদের দুজনকেই সাথে নেয়। পা ব্যথা করলেও হাঁটতে গিয়ে অনেক ভালো লেগেছে বলে জানায় মারজানা।
বিষয়টি নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৬ মার্চ সিলেটের হযরত শাহজালাল (র.) মাজারে পৌঁছানো লক্ষ্যে কয়েকদিন আগে গাইবান্ধা থেকে হেঁটে রওনা দেব আমরা। সেখানে পৌঁছে মাজার, ক্যান্টনমেন্ট ও প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেখবো। মানুষকে হাঁটাহাঁটির প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে ও দেখে আসা ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে যাতে অন্যরা পরিদর্শনে যায় এবং সুস্থ্য বিনোদনের ব্যবস্থা হয় এজন্য সেসব স্থান ও এলাকা সম্পর্কে ফেইসবুকে প্রচার-প্রচারণাও করছি।
কেন এতো বেশি হেঁটেছেন প্রশ্ন শুনে সাদেক আলী সরদার বলেন, একটি মহৎ উদ্দেশ্যে আমরা বাবা-ছেলে হাঁটছি। বলা যেতে পারে সেই মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পূর্ব প্রস্তুতি এটি। যতোদিন না সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি, ততদিন হেঁটে হেঁটে নতুন নতুন এলাকা দেখতে যাওয়া চলমান থাকবে। আর তা কয়েক হাজার কিলোমিটারও হতে পারে। সাদেক আলী সরদার আরও বলেন, আমাদের এই যাত্রা পথে সুন্দরগঞ্জের হযরত আলী ও বগুড়ার কবির হোসেনসহ বেশ কয়েকজন হেঁটেছেন বেশ কিছুটা পথ। চলতি পথে দিয়েছেন অনুপ্রেরণা, দিয়েছেন সাহস। কেউ এই ভ্রমণে সাথে থাকতে চাইলে তাদের স্বাগত জানান এই বাবা-ছেলে।
হাঁটলে শরীর ভালো থাকে জানিয়ে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডা. মো. মাহবুব হোসেন বলেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থুলতাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ। ফলে বেশি বেশি হাঁটাহাটি ও শরীর চর্চার পাশাপাশি পরিমিত খাদ্যাভাস গড়ে তুললে শরীরে কোন অসুখ বাসা বাঁধবে না। পায়ে ব্যথাসহ কোন সমস্যায় পড়লে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।