দুরূহ কাজে কঠিন পরিচয় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে তাঁর হাতে দেশ শাসনের ভার দিয়েছিল জনগণ। সেই থেকে টানা তিন মেয়াদে ১২ বছর ধরে দায়িত্বটি পালন করছেন তিনি।
গত ৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ছিল সরকারের বর্তমান মেয়াদের দুই বছর পূর্তি। ওই দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বর্তমান সরকারের যেমন প্রধান, তেমনি দেশের নেতা হিসেবে সব সংকটে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে নিরন্তর চেষ্টা, সেই অভিযাত্রায়ও তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
গত বৃহস্পতিবার বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দিতে এসে তিনি সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা অন্তত ঈর্ষাকাতরদের ভালো লাগবে না। কারণটি খুবই স্পষ্ট। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইশতেহার দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূল করে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতা মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। লক্ষ্য ছিল, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধিশালী-মর্যাদাশীল দেশ। আমরা দেখতে পাচ্ছি ২০২১ সালের আগেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে আমাদের পথনকশা তৈরি করা হয়েছে। রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার ২০২১-২০২৫ মেয়াদি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এক কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে নেমে আসবে। ২০২৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৮.৫১ শতাংশে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সরকার বদ্বীপ পরিকল্পনা নিয়েছে। মহামারির মধ্যেও পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোর কাজ শেষ করতে পেরেছে।
২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে। অথচ ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা বর্তমানে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে আরো মোট সাত হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে।
অব্যাহত নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে ‘বিপ্লব’ সাধিত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ থেকে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। মাছ-মাংস, ডিম, শাক-সবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার বা তার বেশি লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আরো ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক তারও বেশি লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬.৭৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং এক হাজার ১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪২৮টি নতুন রেল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ছয় হাজার ৫২০ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এ অর্জন এত সহজ ছিল না। ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেয় নতুন সরকার। ২০২০ সালের শুরুতেই করোনা মহামারির ছোবলে বড় ধাক্কা লাগে দেশের অর্থনীতিতে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার করোনা মোকাবেলায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যা মোট জিডিপির ৪.৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৫.২৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের প্রাক্কলন অনুযায়ী এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭.৪ শতাংশে। ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫.০৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ৭.৮৬ শতাংশ হয়েছে। সমালোচকরাও এখন বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি গত এক যুগে ইতিবাচক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। সাফল্যজনকভাবে এমডিজি অর্জনের পর দেশ এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আরেকটি বড় বাধা রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরো চার লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। এরই মধ্যে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনায় সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় থাকা রোহিঙ্গার মধ্যে তিন হাজার ৪৪৬ জন গত ডিসেম্বর দুই দফায় ভাসানচরে পৌঁছেছে। কক্সবাজারের অস্বাস্থ্যকর ক্যাম্পের চেয়ে ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনেক বেশি ভালো থাকার সুযোগ পাবে রোহিঙ্গারা।
২০০৯ থেকে ২০২০—শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ আজ বহির্বিশ্বে একটি সমীহের নাম। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আজ চোখে পড়ার মতো। অথচ রাজনৈতিকভাবে অন্ধ একটি গোষ্ঠী এই অর্জন চোখে দেখতে পায় না। ২০০৮ সালে জনগণ যে দলটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে বলছে ‘কথামালার ফুলঝুরি’। তাঁর ভাষণকে ‘বিভ্রান্তিকর’, ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ ও ‘অন্তঃসারশূন্য’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দলটি। অন্যদিকে সরকার পরিবর্তনে বৃহত্তর গণঐক্য তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন এক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী মির্জা।
এক কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয় এ দেশের মানুষ। শেখ হাসিনা গত ১২ বছর দেশ পরিচালনায় যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ও তাঁর নেতৃত্বকে যে পর্যায়ে উন্নীত করেছেন, তাতে ‘বাংলাদেশবিরোধী’ ‘জামায়াত-ঘনিষ্ঠ’ বিএনপি ঈর্ষান্বিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ সব সংকট মোকাবেলায়—রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দুরূহ কাজে’ ‘কঠিন পরিচয়’ দিতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। সেটাই বিরোধীদের চক্ষুপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের কাছে যাওয়ার মতো কোনো ইস্যু তাদের নেই। করোনার কারণে রাজনীতি ঘরে ঢুকে গেছে। করোনা চলে গেলেও এই গৃহবাসী জামায়াতি-জাতীয়তাবাদীরা মাঠে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। ইতিবাচক রাজনীতি নিয়ে মানুষের কাছে যেতে হলে তাদের চশমার কাচ বদলাতে হবে। দৃষ্টি আর দৃষ্টিভঙ্গি—দুটি জিনিস বদলাতে পারলে তারাও দেখতে পাবে, আজকের বাংলাদেশ কতটা উজ্জ্বল ও ইতিবাচক। এই পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের রূপকার এক স্বপ্নদর্শী নেতা, যাঁর নাম শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান এক সম্মানজনক উচ্চতায়।
লেখক : সাংবাদিক, ছড়াকার