গাইবান্ধাগাইবান্ধা সদরফুলছড়িসাঘাটা

দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় গাইবান্ধায় মাধ্যমিকের ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর খোঁজ মিলছে না

করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ সংক্রমনের প্রভাবে প্রায় ১৮ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা জেলার ৩৫৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর কোন হদিস না মেলায় পড়ালেখার ফিরে আসা অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বাল্যবিয়ে, শিশু শ্রম, পরিবারের সদস্যদ্যের সাথে অন্যত্র যাওয়াকে মনে করছেন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। আর অভিভাবকেরা মনে করেন, শিক্ষকদের নিয়মিত খোঁজ-খবরের অভাব এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা আর দরিদ্রতার কারণে পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়েছে এসব শিক্ষার্থীরা।

গাইবান্ধার সাঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২ জন ছাত্রীর অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল কিন্ত পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করেছে ১৩০জন। আবার নবম শ্রেণিতে ২২০ জন ছাত্রীর মধ্যে রেজিষ্ট্রেশন করেছে ১৭২জন।

সাঘাটা পাইলট হাইস্কুলের চিত্রও একই। এই বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর অষ্টম শ্রেণিত ২০৫ জনের মধ্যে পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করেছেন ১৫৩জন আর নবম শ্রেণিতে ২২২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে রেজিষ্ট্রেশন করেছেন ২০০ জন। বিদ্যালয়টির সহকারি শিক্ষক আনিছুর রহমান জানান, বাড়িতে যোগাযোগ করে কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। অনেকে কাজের সন্ধানে অন্যত্র গিয়েছে। যার ফলে অনেক চেষ্টা করেও শিক্ষার্থীদের রেজিষ্ট্রেন করানো সম্ভব হয়নি।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়া গণ উন্নয়ন একাডেমির প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, ৮ম শ্রেণিতে ৮৫ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলতি বছর পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করেছে ৪৫জন এবং নবম শ্রেণিতে ৯৯ জনের মধ্যে ৪৩ জন রেজিষ্ট্রেশন করেছে। তিনি বলেন, করোনায় স্কুল বন্ধ আর নদীভাঙনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থানে চলে যাওয়ায় কারণে তাদের খোঁজ মিলছে না।

জেলার কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলোর অবস্থাও একই। গাইবান্ধার জুমারবাড়ি ডা. আ. রাজ্জাক শিশু নিকেতন এর অষ্টম শ্রেণিতে ২০৫ জনের মধ্যে ১৫৩ জন রেজিষ্ট্রেশন করেছে আর নবম শ্রেণিতে ২২২ জনের রেজিষ্ট্রেশন করেছে ২০০জন। এই বিদ্যালয়ের পরিচালক রেজাউল ইসলাম জানান, ১৮ মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকায় শিক্ষককেরা অন্যত্র চলে গেছেন। একারণে কিছুদিন শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা গেলেও পরবর্তীতে নিয়মিত যোগযোগ করা সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, বাল্যবিয়ে ও কাজের সন্ধানে শিক্ষার্থীরা অন্যত্র যাওয়ায় তাদের সন্ধান মিলছে না।

সদর উপজেলার জিইউকে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহানা নাজনীন বলেন, বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের। কাজের সন্ধানে সেই পরিবারগুলো এলাকা ছাড়া হয়েছে আর মেয়ে শিশুরা বিয়ে করে স্বামীর বাড়িতে চলে গেছে।

সাঘাটা বালিকা বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, রেজিষ্ট্রেশন না করা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। এ কারনে পড়ালেখার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই এবং বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।

ফুলছড়ি উপজেলার দেলুয়াবাড়ি চরের আব্দুল বারেক সরকারের দু’সন্তান অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। কিন্তু অভাবের কারণে গতবছর ঢাকায় একটি কোম্পানিতে কাজ করতে যান। স্বল্প উপার্যনে দু’সন্তানের পক্ষে আর পড়ালেখায় ফিরে আসা সম্ভব না বলে জানান ওই অভিভাবক।

অনেক বিদ্যালয়ের চিত্র আবার বেশ ভাল। সদর উপজেলার দায়িরাপুর আমানউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় সুত্র জানা যায়, ৮ম শ্রেণিতে ২৬৭জনের মধ্যে ২৪৩ জন রেজিষ্ট্রশন করেছে এবং নবম শ্রেণিতে রেজিষ্ট্রেশন করেছে ২৬৯ জনের মধ্যে ২৩৯জন।

স্থানীয় সাংবাদিক আবু তাহের জানান, শিক্ষকেরা যদি নিয়মিতভাবে অনলাইন কিংবা ছোট গ্রæপে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিতো তাহলে হয়তো বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর হার অনেকটাই কমে যেতো।

বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম জানান, চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মাইগ্রেশন ও শিশু বিয়ের সম্ভাবনা থাকলেও মেইনল্যান্ডের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণে রেজিষ্ট্রেশন না করার চিত্র অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ও বিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে শিক্ষক ও অভিভাবকের সমান দায়িত্ব ছিল। তিনি জানান, পড়ালেখার সাথে সম্পৃক্ত না এমন দুর্বল শিক্ষার্থীরাই ঝড়ে পড়েছে।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন জানান, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা কৌশলে তাদের বিয়ে দিয়েছেন। আর দরিদ্র পরিবারের ছেলে শিক্ষার্থীরা কাজের জন্য ঢাকা, গাজীপুর, নারায়গঞ্জ যাওয়ায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তবে, তিনি মনে করেন বিদ্যালয় চালু হলে শিক্ষার্থীরাও বিদ্যালয়ে ফিরে আসবে এবং ঝড়ে পড়ার হারও অনেক কমে আসবে।

সুত্র: আমারজেলা ডট নিউজ

Back to top button