গাইবান্ধায় শিশুদের সাথে দায়িত্ববাহকদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

আজ ২২ সেপ্টেম্বর, বুধবার সকালে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলার শিশু অধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে দায়িত্ববাহক কর্মকর্তাদের সাথে শিশুদের সমস্যা বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে শিশু অধিকার বাস্তবায়নকারী শিশু সংগঠন ন্যাশনাল চিলড্রেন’স টাস্কফোর্স (এনসিটিএফ) গাইবান্ধা জেলা কমিটির আয়োজনে এবং জেলা প্রশাসন গাইবান্ধা ও সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় উক্ত মতবিনিময়টি সম্পন্ন হয়। এনসিটিএফ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও গাইবান্ধা জেলা কমিটির সভাপতি কে.এইচ. খান রোহান এর সভাপতিত্বে সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শিশুদের সমস্যার কথা শোনেন গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক (রুটিন দায়িত্ব) মোছাঃ রোখছানা বেগম।
সংলাপে আরো উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সাদেকুর রহমান, পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি জেলা অপরাধ শাখার পরিদর্শক মো. মাহবুবুল আলম, জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস.এম ফয়েজ উদ্দিন, জেলা শিক্ষা অফিসার মো. এনায়েত হোসেন, গাইবান্ধা সরকারি কলেজের প্রভাষক মো. মশিউর রহমান, গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুশান্ত কুমার দেব, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) এর প্রোগ্রাম অফিসার মো. রুহুল আমিন সরকার, গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক রেজাউল করিম, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি গাইবান্ধা এর লাইব্রেরিয়ান মোছা. রেবেকা পারভীন ও সেভ দ্য চিলড্রেন এর ফিল্ড অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সৈকত।
ইয়ুথ প্লাটফর্ম এর সদস্য মেহেদী হাসান অন্তর এর সঞ্চালনায় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন এনসিটিএফ এর সাধারণ সম্পাদক তাওফিক ওমর হিমন। এছাড়াও গত ৮ মাসের জেলার শিশু পরিস্থিতি উপস্থাপন করেন এনসিটিএফ গাইবান্ধা জেলা ভলান্টিয়ার মোঃ তাওহীদ উল ইসলাম তুষার।
সংলাপে শিশুরা ইস্যু ভিত্তিক সমস্যা ও তা সমাধানের জন্য সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন। বাল্যবিবাহ, শিশুদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, জন্মনিবন্ধন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও বিনোদন সম্পর্কিত ১০ টি সমস্যার বিপরীতে ২২ টি সুপারিশ করে শিশুরা। এসময় শিশুরা বলেন, আমরা গত আটমাসে গাইবান্ধা জেলার শিশু জেলার ১৮০ জন শিশুর মতামতের উপর একটি অনলাইন জরিপ ও এলাকা ভিত্তিক ফিল্ড মনিটরিং পরিচালনা করি। যেখানে শিশুরা তাদের মতামত প্রদান করে। তাদের মতামতের আলোকে আজকের সংলাপে সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হলো।
শিশুদের সুপারিশমালায় উল্লেখযোগ্য ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে শিশু, তরুণ ও অভিভাবকদেরকে সচেতন করা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় শিশু সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। দূর্যোগপ্রবণ এলাকায় শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা। জলবায়ু বিষয়ক নীতিনির্ধারণী ফোরামে শিশুদের অংশগ্রহণ ও তাদের মতামত গ্রহণ করা। জেলায় বাল্য বিবাহ রোধে কিশোর-কিশোরী ও অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করা। সরকারি টোল ফ্রি নাম্বার ৩৩৩, ৯৯৯ এবং ১০৯ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিত কারণে ব্যবস্থা গ্রহণ। বাল্যবিবাহ হ্রাসকরণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের সাথে স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করা। শিশুর জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম সহজ করা। স্কুল কলেজ শুরু ও শেষ হবার সময়ে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রেম্প সিড়ি স্থাপন করা। শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা। শিশু আইন-২০১৩ এর বিধানগুলো প্রতিপালন করা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে অবৈধ ট্রাক্টর ও কাকড়ার দিনের বেলায় চলাচল বন্ধ করা। স্কুল কলেজের সামনে স্পীড ব্রেকার নির্মাণ ও তা রং দিয়ে চিহ্নিত করা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা শিশুদের নিকট বিড়ি সিগারেট মাদক বিক্রি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চরাঞ্চলে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
সংলাপে উপস্থিত জেলা শিক্ষা অফিসার মো. এনায়েত হোসেন বলেন, করোনাভাইরাস পরবর্তীতে স্কুল গুলো খুলে দেয়া হয়েছে। স্কুল গুলোর পরিবেশ অগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে। শিশুদের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সকলকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্কুলে টয়লেট, খেলার মাঠ সব পরিস্কার রাখা হয়েছে। স্কুলে শিশুদের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সাদেকুর রহমান বলেন, শিশুদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও সমাবেত হওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী সকল শিশু এই অধিকার লাভ করেছে। শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতকরনে আমাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি আরও বলেন আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের ও শিশু সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিচার শিশু আদালতে হয়ে থাকে। প্রতিটি জেলায় এই শিশু আদালত রয়েছে। এসব আদালতের সম্মানিত বিচারকগণকে যদি এধরণের প্লাটফর্মে আনা যায় তাহলে শিশু অধিকার সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ ও সমস্যা সমাধান সহজ হবে। এ বিষয়ে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জেলা প্রশাসক মোছাঃ রোখছানা বেগম শিশুদের উত্থাপিত সমস্যা ও সুপারিশ গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন ও তা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, গাইবান্ধায় বালবিবাহের হার অনেক বেশি। আমাদের করা একটি জরিপে এর পরিসংখ্যান ছিল শতকরা ৮১ ভাগ। আজকে শিশুদের করা জরিপে জানতে পারলাম এর সংখ্যা শতকরা ৬৩ ভাগ। আমরা মনে করছি আমাদের সম্মিলিত প্রচেস্টায় বাল্যবিয়ের হার অনেকটা কমে এসেছে।
শিশুর জন্মনিবন্ধন বিষয়ে তিনি বলেন, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর জন্মনিবন্ধন ফ্রি, এরপর করলে ২৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। আর তথ্য সংশোধনের ক্ষেত্রে ফি নির্ধারিত ১০০ টাকা। কেউ এসব ফি এর অতিরিক্ত দাবি করলে তা তাকে ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর জন্য অনুরোধ করেন তিনি। এছাড়াও জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমে কেউ যাতে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে না পারেন এজন্য তিনি এনসিটিএফ সদস্যদের সচেতন থাকার ও মাঠপর্যায়ে কাজ করার জন্য অনুরোধ করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কাজ করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ধনীদেশের ফোরাম গুলোতে বিভিন্ন দাবি সংবলিত সুপারিশমালা উপস্থাপন করছেন।
জেলা প্রশাসক এনসিটিএফ এর কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, পড়ালেখা ঠিক রেখে স্বেচ্ছাসেবামুলক কাজ করতে হবে। তিনি শিশু অধিকার বাস্তবায়নে এনসিটিএফ এর কাজে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
মতবিনিময় সভায় এনসিটিএফ জেলা কার্যনির্বাহী কমিটি ও ইয়ুথ প্লাটফর্ম সদস্যসহ ১৫ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।