গাইবান্ধাগাইবান্ধা সদরফুলছড়ি

গাইবান্ধার চরাঞ্চলে শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত ৩৭ শতাংশ শিশু

পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও তার উপায় নেই, নদীবেষ্টিত গাইবান্ধার চার উপজেলার ২৮ ইউনিয়নে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের। চরে পর্যাপ্ত স্কুল না থাকায় থমকে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া। শিক্ষা সুযোগ বঞ্চিত হয়ে বাল্য বিবাহসহ নানা সামাজিক বিচ্যুতি ও চরভিত্তিক নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে এখন ৩৭ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তবে, প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মধ্যে সঠিক কোন তথ্য না থাকায় বিদ্যালয় বঞ্চিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এতে করে সরকারের শতভাগ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে।

জেলার সাঘাটা, ফুলছড়ি, সদর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ২৮টি নদী ও চররেবষ্টিত ইউনিয়নে ৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বসবাস করে চরাঞ্চলে। চরকেন্দ্রীক প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও অভিভাবকেরা শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারছেন না। এছাড়াও নদীভাঙন, বন্যা, দারিদ্রতা, যোগাযোগ সমস্যা, স্থানীয়ভাবে কাজের সুযোগ না থাকায় বিদ্যালয় থেকে শিশু ঝড়েপড়ার হার জেলার মেইনল্যান্ডের চেয়ে চরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি।

এ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ছিন্নমূল মহিলা সমিতির সমন্বয়কারী এবিএম মাহমুদুন্নবী জানান, চরাঞ্চলে প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীর হার প্রায় ৬৬ শতাংশ। কাছাকাছি বিদ্যালয় না থাকা, দারিদ্রতা, বন্যা ও নদভাঙনের কারণে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

গাইবান্ধার কালুরপাড়া চরের মোগল মোল্লা জানান, নদী ভাঙনে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বিভিন্ন চরে আশ্রয় নেওয়ায় দু’কন্যাকে বিদ্যালয় পাঠাতে পারেনি। অভাব-অনটনের কারণে কাজের জন্য ঢাকায় বাসাবাড়িতে রেখেছেন দু-কন্যা শিশুকে।

সাঘাটার দিঘলকান্দি চরের রাজু মোল্লার ছেলে শাকিল মোল্লা চলতি বছরে ১০ম শ্রেণিতে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু গত বছর তাকে সামাজিক চাঁপে বিয়ে দেয়া হয়েছে মান্নান সরকারের শিশু কন্যা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর সাথে। রাজু মোল্লা জানান, চরের প্রেক্ষাপট এখনও এরকম। শিশু বিয়ে হলে কেউ বাঁধা দেয় না বা প্রতিবাদ করে না বলেই চরের শিশুরা শিক্ষা থেকে অল্প বয়সে ঝড়ে পড়ছে।

সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়ের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জাকির জানান, নদীভ্ঙানে গত বছর এই চরে ৮০ পরিবার স্থানান্তরিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এখানে প্রায় দেড় শতাধিক বিদ্যালয়গামী শিশু আছে কিন্তু কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রজেক্ট অফিসার (শিক্ষা) আক্কাস আলী আকন্দ জানান, গাইবান্ধার নদী ও চরাঞ্চলের আশপাশের অভিভাবকেরা শিশুদের নিয়ে কাজের সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়-এতে করে বন্ধ হয়ে যায় সন্তানের পড়ালেখা। এজন্য শিক্ষাধারা চলমান রাখতে উপানুষ্ঠানিক বা ব্রীজ স্কুল চালু রাখা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

জেলা প্রাথমিক শিখ্ষা অফিসের একটি পরিসংখ্যাণ অনুযায়ী জেলায় শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার ৩৭ শতাংশ। তবে চরাঞ্চলে এই চিত্র আরো বেশি।

গাইবান্ধা জেলা উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান জানান, নানা কারনে জেলার চরাঞ্চলে শিশুরা বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ছে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। তবে, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় উপানুষ্ঠানিক বা ব্রীজ স্কুল চালু করার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তিনি জানান, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল¯্রােতোধারায় ফিরিয়ে আনতে গড়ে ২ হাজার ১শ’ জন করে শিশু নিয়ে শিখন কেন্দ্র চালুর বৃহত প্রকল্প নিলেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অসহযোগিতায় তা বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিভাগের সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাঘাটায় চরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, প্রতিবছর বিদ্যালয় ক্যাচম্যান্ট এলাকায় শিশু জরিপ করে তথ্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে পাঠানো হয়। প্রকৃতভাবে খাতা কলমে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তি দেখানো হলেও বাস্তবে তা নেই বলে জানান এই শিক্ষক।

শিক্ষাবীদ অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম জানান, চরাঞ্চল কেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শিশুরা যাতে সহজেই বিদ্যালয়ে যেতে পারে এমন শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন করা প্রয়োজন। সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলে যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় চরাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার মান নি¤œমূখী বলে তিনি জানান।

ফুলছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) কামরুজ্জামান শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া হার উড়িয়ে দিয়ে বলেন, চরাঞ্চলে ৫ থেকে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে। এজন্য তিনিও বন্যা ও নদীভাঙনের কারনে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো স্থানান্তরিত হওয়াকেই দায়ী করেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন গবেষক গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস সালাম জানান, পরিবর্তনজনিত জলবায়ুর কারণে চরাঞ্চলের শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এজন্য দুর্যোগ ও জলবায়ু বিষয়টি পরিকল্পনায় নিয়ে বিদ্যালেয়র ধরন, শিক্ষকদের আবাসন, পড়ালেখার মান নিয়ে কাজ করতে হবে।

সুত্র: আমারজেলা ডট নিউজ

Back to top button